ব্যবস্থাপনার সর্বজনীনতা বলতে সকল ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনার আবশ্যকতা বা ব্যবস্থাপনা জ্ঞানের প্রয়োগযোগ্যতাকে বুঝানো হয়ে থাকে। বৃহদায়তন প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় ব্যবস্থাপনার আবশ্যকতা যেমনি দৃশ্যমান ছোট প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও ব্যবস্থাপনা অপরিহার্য। যথোপযুক্ত পরিকল্পনা গ্রহণ করে সে অনুযায়ী কাজ করলে উভয় ধরনের প্রতিষ্ঠানই লাভবান হতে পারে। পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য ছোট-বড় সব প্রতিষ্ঠানকেই উপায়-উপকরণাদি সংহতকরণ, কর্মীসংস্থান, নির্দেশনা, প্রেষণা, সমন্বয়, নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি কাজ সম্পাদন করতে হয় । এ কারণেই বলা হয়ে থাকে যে, ‘ব্যবস্থাপনা সর্বজনীন' ।
গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিস এর নাম সুবিদিত। প্রায় আড়াই হাজার বছর পূর্বে গ্রীক সভ্যতাকালে তিনি ব্যবস্থাপনা সর্বজনীন (Management is universal) এ বিষয়টি তুলে ধরেছিলেন। এ নিয়ে চমৎকার একটা ঘটনার বর্ণনা রয়েছে । তিনি একদিন তাঁর ছাত্র ও ভক্তদের আসরে আলোচনা প্রসঙ্গে বললেন, 'সাবান কারখানার একজন দক্ষ ম্যানেজারকে সেনাধ্যক্ষ বা সামরিক সচিবের দায়িত্ব দেয়া হলে সে দক্ষতার সাথে তা পালন করতে পারবে ।' তখনকার দিনে গ্রীক সমাজে সৈন্যদের ব্যাপক প্রভাব। সেনাকর্মকর্তাগণ সক্রেটিসের এ বক্তব্যকে তাঁদের জন্য অপমানকর মনে করলেন । কারণ তখনকার দিনে সাবান কারখানা নেহায়েতই ছোট ছিল । তার ম্যানেজারের সাথে তাদের তুলনাকে তারা কোনভাবেই মেনে নিতে পারছিলেন না । অভিযোগ রাজার দরবারে উত্থাপিত হলো । রাজা সক্রেটিসকে ডেকে তার এরূপ বক্তব্যের কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। সক্রেটিস সবার সামনে বললেন, ‘একজন সেনাধ্যক্ষ যুদ্ধের পরিকল্পনা করেন, সৈন্য ও রসদপত্র জোগাড় করে তাকে সংহত করেন, যুদ্ধের নির্দেশ দেন, সৈন্যদের উৎসাহ দেন, যুদ্ধ শেষে জয়-পরাজয় নিয়ে পর্যালোচনা করেন, ভুলভ্রান্তি থাকলে তা সংশোধন করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেন । একজন সাবান কারখানার ম্যানেজার সাবান উৎপাদনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন, প্রয়োজনীয় জনশক্তি ও কাঁচামাল সংগ্রহ করেন, কর্মীদের কাজের নির্দেশ দেন, তাদের উৎসাহিত করেন এবং নির্দিষ্ট সময় শেষে পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ হয়েছে কি না তা দেখে ভুলভ্রান্তি থাকলে তা সংশোধন করে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন । তাই ক্ষেত্রগত পার্থক্য থাকলেও ব্যবস্থাপনা একটা সর্বজনীন বিষয় যা সকল সমাজে সর্বকালে সবধরনের প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। যে কারণে সাবান কারখানার একজন দক্ষ ম্যানেজারও প্রতিরক্ষা সচিবের দায়িত্ব দক্ষতার সঙ্গে পালন করতে সক্ষম।' তাঁর বক্তব্যে রাজা সন্তুষ্ট হলেন ।
এমন কোনো প্রতিষ্ঠান নেই যা ব্যবস্থাপক বা নির্বাহী ভিন্ন চলতে পারে । তাই ব্যবস্থাপনার অস্তিত্ব সর্বক্ষেত্রেই বিদ্যমান । একজন পরিবার প্রধান যেমনি ব্যবস্থাপক তেমনি একজন রাষ্ট্রপ্রধানও এক অর্থে ব্যবস্থাপক । পরিবার প্রধান যদি পরিকল্পিতভাবে পরিবারের অন্যান্য সদস্য ও উপকরণাদির ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারেন তবে তার পক্ষে লক্ষ্যার্জন সম্ভব হয় । অন্যদিকে একজন রাষ্ট্রপ্রধানকেও তাঁর জনগণ ও সহায়-সম্পদের কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করার প্রয়োজন পড়ে ।
ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়ার সকল কাজ; যেমন- পরিকল্পনা, সংগঠন, কর্মীসংস্থান, নির্দেশনা, প্রেষণা, সমন্বয় ও নিয়ন্ত্রণ যেমনি বড় ধরনের প্রতিষ্ঠানের বেলায় প্রযোজ্য তেমনি একটি সাধারণ প্রতিষ্ঠানেও লক্ষ্যার্জনের জন্য ব্যবস্থাপনার এ সকল কাজ সম্পাদনের প্রয়োজন দেখা দেয় ।
উপরোক্ত আলোচনা হতে প্রতীয়মান হয় যে, দলবদ্ধ যেকোনো কাজ বা প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনা একটি অতি অপরিহার্য উপাদান। সকল সমাজেই ব্যবস্থাপনার কাজের ধরন ও প্রকৃতি মোটামুটি একই ধরনের। প্রায়োগিক ক্ষেত্রে চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রতিষ্ঠান ও সমাজভেদে কিছুটা পার্থক্য হলেও যতোই দিন যাচ্ছে এ পার্থক্য ততোই হ্রাস পাচ্ছে । তাই ব্যবস্থাপনা একটি সর্বজনীন বিষয় তা বলা যেতে পারে । এ কারণেই Koontz, "Effective managing is the concern of the corporation president, the hospital Weihrich administrator, the government, first-line superviser, the Boy - Scout leader, the bishop in the church, the baseball manager and the university president.” অর্থাৎ সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা বড় কর্পোরেশনের প্রেসিডেন্ট, হাসপাতালের পরিচালক, সরকারি প্রথম সারির তত্ত্বাবধায়ক, বয়স্কাউট লিডার, গীর্জার পাদ্রী, বেসবল দলের ম্যানেজার এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট সবার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ।